ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর বাংলাদেশে ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিশু খোলা আকাশের নিচে বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরবাড়িতে বাস করছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন।

সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। ৮-১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। রিমালের আঘাতে ১৬ জন নিহত এবং প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যাদের মধ্যে আনুমানিক ১৬ লাখ শিশু।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯টি জেলায় অন্তত ১ লাখ ৫০ হাজার বসতবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং প্রায় ৬ লাখ ৯৩ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭৪ হাজার শিশু রয়েছে। বন্যার কারণে অনেক এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না।

সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, প্রায় ৫০ জন মানুষ এখনও বন্যার পানিতে আটকে আছে। অন্যান্য গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, শুধুমাত্র নৌকা ছাড়া কোনো যোগাযোগের উপায় নেই। উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক পরিবারের আয়ের মূল উৎস কৃষিজমি এবং চিংড়ি ও মাছের খামার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে যেসব এলাকায় আগে থেকেই পানি সংকট ছিল, সেখানে কূপ ও পানির উৎসগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা পরিষ্কার পানির সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঝড়ের কারণে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মোবাইল টাওয়ার ভেঙে গেছে এবং হাজার হাজার গাছ রাস্তায় পড়ে যোগাযোগ ও ত্রাণ তৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এখনও বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় আহমেদ (ছদ্ম নাম, বয়স ৫৭ বছর) তার বাড়িতেই ছিলেন। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যায় তার বাড়িঘর তলিয়ে যায়। আহমেদ বলেন, ‘আমার বাড়িঘর সব পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি আমার গলার ওপর পর্যন্ত চলে আসায় আমি ডুবে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসেনি। কারো ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে গেছে, কারো ঘরবাড়ি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। আমার ৩টা ছাগলই পানিতে ভেসে গেছে।’

সেভ দ্য চিলড্রেনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বলেন,

‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের ঘূর্ণিঝড়ের আগে থেকেই সহায়তা প্রয়োজন ছিল। এখন ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিশু ঘরবাড়ি হারিয়েছে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে বাস করছে। এই শিশুদের ও তাদের পরিবারের অবিলম্বে আশ্রয়, খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি প্রয়োজন। তবে পরবর্তীকালে তাদের আরও সহায়তা লাগবে। জীবিকা হারিয়ে এই পরিবারগুলো দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে এবং সন্তানদের ভরণপোষণের কোনো উপায় নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চল এবং কমিউনিটির মানুষের জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার সক্ষমতা কমে যাবে। ধীরে ধীরে শুরু হওয়া এই সংকটের কারণে শিশুদের জীবনেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ৬০ লাখ মানুষ দুর্ভোগের শিকার, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৬ লাখ এবং ২০৮০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪৮ লাখ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

বিশ্ব নেতাদের দ্রুত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সুমন সেনগুপ্ত বলেন,

‘বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোকে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে যেসব শিশু দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের শিকার তাদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।’

উল্লেখ্য, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে। আমরা সরকার, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে কাজ করি যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক সাড়া প্রদান করা যায়। আমরা আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি ও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এমনভাবে পরিকল্পনা করি যাতে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে।