ডলারের তেজে বিশ্বের বাকি মুদ্রাগুলোর অবস্থা ভালো নয়। চলতি বছর বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রাই মার্কিন ডলারের বিপরীতে মূল্য হারিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।

ব্লুমবার্গের এক জরিপের সূত্রে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ বলা হয়েছে, চলতি বছর বিশ্বের ১৫০টি দেশের মুদ্রা মার্কিন ডলারের বিপরীতে মূল্য হারিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করলে ডলার তেজি হয়।

আশা ছিল, চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেড সুদহার কমাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি আবার কিছুটা বাড়তে শুরু করায় ফেড আপাতত নীতি সুদহার কমাচ্ছে না; ঠিক সে কারণে ডলার নতুন করে আবার শক্তি পাচ্ছে।
নীতি সুদহার ওপরের দিকে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগের সুদহার এখনো বেশি। সে কারণে সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা আবার মার্কিন আর্থিক সম্পদের দিকে ছুটছেন এবং বলা বাহুল্য, সেই বিনিয়োগ করতে হচ্ছে ডলারে। এতে ডলারের চাহিদা বাড়ছে; বাড়ছে এর বিনিময় হার।

সংবাদে বলা হয়েছে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এত বেশি পরিমাণে অর্থ ঢুকেছে যে দেশটির নীতিপ্রণেতা, রাজনীতিবিদ এবং এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেইজিংয়ের নীতিপ্রণেতারাও নড়েচড়ে বসেছেন।

মার্কিন ডলারের তেজ পরিমাপের সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ইউএস ডলার ইনডেক্স। বিশ্বের আরও ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান নিরূপণ করতে এই সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে এই সূচকের মান এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকের পর তা কখনোই আর এই উচ্চতায় ওঠেনি। পরিণামে জাপানি ইয়েনের মান এখন গত ৩৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন; ইউরো ও কানাডীয় ডলারের মান পড়ছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা চেষ্টাচরিত্র করেও ইউয়ানের দুর্বলতা কাটাতে পারছে না।

এ বাস্তবতায় মুডিস অ্যানালিটিকসের অর্থনীতি জেসি রজার্স বলেছেন, ফেড যে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এখনকার মতো তা আর কখনো এতটা সত্য হয়ে ধরা দেয়নি।

ডলারের মান বাড়লে অর্থনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক লেনদেন হয় ডলারে। ফলে ডলারের মান বাড়লে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে থেকে পণ্য আমদানির ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি তেলের মতো পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। যেসব দেশ ডলারে ঋণ দিয়েছে, তাদের ঋণ পরিশোধ আরও ব্যয়বহুল হয়ে যায়। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তাদের সুবিধা হয়। ডলারের বেশি দর পাওয়ার পাশাপাশি মার্কিন নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়।

চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে যে অপ্রত্যাশিত উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, তার মধ্য দিয়ে ধারণা করা হয় যে মূল্যস্ফীতি মূল সমস্যা নয়। মার্কিন অর্থনীতি চাঙা হলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও গতি আসে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার কমে এলে এবং এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকলে আর তার সঙ্গে নীতি সুদহার ওপরের দিকে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের নীতিপ্রণেতারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন। একদিকে তাঁদের মনে হতে পারে যে নীতি সুদহার হ্রাস করে দেশীয় অর্থনীতি চাঙা রাখা দরকার। কিন্তু সেটা করতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। অথবা তাঁদের নিজেদের মুদ্রার পতন ঠেকাতে নীতি সুদহার ওপরের দিকে রাখতে হবে।

মার্কিন ডলারের দর বেড়ে যাওয়ার কারণে এশীয় অর্থনীতি বিপাকে পড়েছে; বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া নিজেদের মুদ্রার দরপতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উভয় দেশের মুদ্রাই এখন অনেক বছরের মধ্যে ডলারের বিপরীতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে।

এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রীরা ওয়াশিংটনে বৈঠক করেছেন।

সেখানে তাঁরা বিদেশি মুদ্রার বাজারের গতিবিধি আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার অঙ্গীকার করেছেন।

তাঁদের এই তৎপরতা দেখেই বোঝা যায়, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে। কোরীয় মুদ্রা ওনের মান এখন ২০২২ সালের পর সর্বনিম্ন। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে গতিবিধি সম্পর্কে বলেছেন, এই অবনমন খুব বেশি।

জাপানি মুদ্রা ইয়েনের পরিস্থিতিও ভালো নয়। সোমবার ডলারের বিপরীতে ইয়েনের দর ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম ১৬০ পেরিয়ে যায়; যদিও তা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি অনেক বছর পর নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। জাপানের মুদ্রার এই দুরবস্থা বেশি দিন চললে বিনিয়োগকারীরা জাপানের ওপর আস্থা হারাতে পারেন—এটাই দেশটির নীতিপ্রণেতাদের শঙ্কা।

ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমানোর চিন্তা করছে। কিন্তু তাদের শঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের নীতি সুদহারের ব্যবধান বাড়লে ইউরোর আরও দরপতন হতে পারে। অন্যদিকে এশিয়ার আরেক দেশ ইন্দোনেশিয়া মুদ্রার মান ধরে রাখতে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। তাদের এই পদক্ষেপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ফল কী।

এ পরিস্থিতি সারা বিশ্বের নীতিপ্রণেতাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। অনেকের মনেই শঙ্কা, অর্থনীতিতে ঝড় আসতে যাচ্ছে।